হাটহাজারীতে কৃষি জমির টপ সয়েল বিক্রির মহোৎসব, উৎপাদন হ্রাসের শঙ্কা

- আপডেট সময় : ০৭:৪১:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ১৮ বার পড়া হয়েছে
হাটহাজারীতে কৃষি জমির টপ সয়েল বিক্রির মহোৎসব, উৎপাদন হ্রাসের শঙ্কাপ্র
শাসনের সহযোগিতার অভিযোগ স্থানীয়দের !
মোঃ এরশাদ আলী, হাটহাজারী:
হাটহাজারী পৌরসভা ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষিজমি, সরকারি খাসজমি, পাহাড়, ছড়ার পাড়ের মাটি কেটে নিয়ে অবৈধভাবে বিক্রি করছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র। রাতের আঁধারে ট্রাকের মাধ্যমে এই মাটি পাচার করা হচ্ছে ইটভাটা ও নির্মাণকাজ এবং পুকুর জলাশয়, সড়কের পাশের সরকারি (সওজ’র) জায়গা, ফসলি জমি ভরাট কাজে। এতে একদিকে যেমন কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, তেমনি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই এ চক্রের তৎপরতা দিন দিন বেড়েই চলছে।
যার ফলে আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে গোচারণ ভূমি, পুকুর জলাশয়, বীজতলা ও কৃষি জমি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে একাধিক চক্র। আর প্রতি বছরের তুলনায় এবারের শীতে ও শুষ্ক মৌসুমি মাটি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে মাত্রার বাইরে । বিশেষ করে রাজনৈতিক পদ পরিবর্তনের পর এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে মাটির ব্যবসা চলছে। কোনো ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করে অবাধে বিক্রি হচ্ছে পাহাড় কাটা মাটি এবং কৃষি জমির টপসয়েল। অবৈধ মাটি ব্যবসায়ী ও ভূমিদস্যুদের পুকুর জলাশয় কৃষি জমি ভরাট এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডে সহযোগিতা করে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন নিজেই এমন অভিযোগ প্রায় সকলের। যার কারণে এসব অবৈধ কাজের তথ্য জানালেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরকারি সম্পদ রক্ষায় বা দখলরোধে এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। এখন সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ফসলি জমির মাটি বিক্রি ও ভরাটের হিড়িক পড়েছে পুরো উপজেলা জুড়ে। আর মাটিবাহী গাড়ির চাপে নষ্ট হচ্ছে আঞ্চলিক বিভিন্ন সড়ক এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি মহাসড়কের বিভিন্ন অংশও। বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে পরিদর্শন কালে মাটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য কারা তা জানতে চাইলে তারা নিজ প্রাণ ভয়ে চক্রের সদস্যদের নাম প্রকাশ না করলেও বলেন, ৫ অগাস্টের পর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় নেতাকর্মীরা উপজেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের পারসেন্টিজ দিয়ে ম্যানেজ করে দাপটের সাথেই চালিয়ে যাচ্ছে এসব অবৈধ মাটি ব্যবসা। পৌরসভার ফটিকা বিল, মোহাম্মদপুর বিল, মাইজ বিল, ছাড়াও উপজেলার, মির্জাপুর, কাটিরহাট, সরকারহাট, ইছাপুর, গড়দুয়ারা সহ অসংখ্য স্থানে কাটা হচ্ছে কৃষি জমির টপসয়েল। সে মাটি সারা রাত ধরে ড্রাম ট্রাক যোগে পৌরসভা ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে ভরাট করা হচ্ছে বিভিন্ন পুকুর, জলাশয়, কৃষিজমি সহ সরকারি সওজের কোটি টাকার মুল্যবান সম্পদ। পুরো হাটহাজারীতে এখন দৌরাত্ম্য চলছে মাটি ব্যবসায়ী ও ভরাটকারীদের।
হাটহাজারী পৌরসভার ফটিকা এলাকার বাসিন্দা প্রবাসী আবদুল সালাম তাওহিদ বলেন, সারারাত ধরে ড্রাম ট্রাকের শব্দে অতিষ্ট হয়ে উঠেছি। প্রতিদিন রাত ১২’টার পর থেকে এ ড্রাম ট্রাকের উৎপাত শুরু হয়। চলে সকাল পর্যন্ত। ‘ কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে হুমকি দেয়।’ প্রশাসনকে জানালে তারা কোনো ব্যবস্থাই নেননা।
ওই এলাকার একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা যেনো একটা মঘের মুল্লুকে ফিরে এসেছি। প্রশাসনের ঘনিষ্ট লোকজন এসব অবৈধ কাজে জড়িত। ৫ অগাস্টের পূর্বে যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসরদের চামচামি আর অপকর্ম করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে গিয়েছিল উপজেলা প্রশাসনের লোকজনের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় এখনো তারাই সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে দাপটের সাথে। কেউ মসজিদের আবার কেউ কবরস্থানের নাম ব্যবহার করে কৃষি জমির টপসয়েল কেটে কৃষি জমি ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা।
শায়েস্তা খাঁ পাড়ার একাধিক ব্যক্তি জানান, গত কয়েকদিন ধরে গভীর রাত ১ টার পর থেকে ড্রাম ট্রাকের শব্দে ঘুমাতে কস্ট হচ্ছিল। উপজেলা প্রশাসন কে জানালে তিনারা ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়ে পর দিন সকালে ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়ে প্রশাসনের উপস্থিতি জানান দিয়ে আসেন। সেদিন আর গভীর রাতে চুপিসারে মাটির ট্রাক চালাতে হয়নি, সেদিন সন্ধ্যা থেকেই প্রকাশ্যে মাটির ট্রাক চলাচল শুরু করে। পরে প্রশাসনকে ঘটনা জানাতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও প্রশাসন সে চেস্টাকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। পরে বুঝলাম তারাও ম্যানেজ হয়ে গেছে। এভাবেই চলছে সব।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনকারী সদস্য মানবাধিকারকর্মী একরামুল হক চৌধুরী বলেন, এভাবে অবৈধভাবে মাটি কাটায় মাটির উপরিভাগে থাকা পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়, ফলে ভবিষ্যতে ওই জমিতে চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে জমির মাটি কেটে নেওয়ার ফলে মাটির জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে পানি সংকটের কারণ হতে পারে, এ ছাড়াও বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও মাইক্রোঅর্গানিজমের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে মাটির প্রাকৃতিক গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। আইনে উল্লেখ আছে নিজের জমি থেকেও কেউ মাটি কেটে বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
হাটহাজারী রেঞ্জ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের কাছে পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বন বিভাগের আওতাধীন কোনো স্থানে যদি পাহাড় কাটা হয় সে ক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা বা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবো। আর এর বাইরে হলে সেটা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং উপজেলা প্রশাসন দেখবেন। বন বিভাগের ভুমির মধ্যে কোথাও পাহাড় কাটার খবর পেলে আমরা সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিবো। এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেও বলেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে সহকারী কমিশনার ভূমি লুৎফর নাহার শারমিনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেস্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বিষয়টি নিয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহীকর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম মশিউজ্জামান জানান, মাটি কাটা চক্রকে সহযোগিতার প্রশ্নই আসে না। আমরা প্রায় সময় টপসয়েল কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি,জরিমানা করছি,স্কেবেটরের ব্যাটারী জব্দ করছি। গত সোমবার গভীর রাতেও অভিযানে গিয়ে পাহাড়ি মাটি ও টপসয়েল দিয়ে জায়গা ভরাট করা বন্ধ করেছি। পাহাড় ও টপসয়েল কাটার ব্যাপারে কোনো ছাড় নাই।