মুরাদনগরে ইট তৈরির চাহিদা মেটাতে কাটা হয়েছে এক হাজার একর কৃষি জমির মাটি
- আপডেট সময় : ০২:৪৬:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫ ২৮ বার পড়া হয়েছে
*গত দুই বছরে উপজেলার ৫০টি ইটভাটায় ৮০ কোটি ইট তৈরির চাহিদা মেটাতে কাটা হয়েছে প্রায় ১ হাজার একর কৃষি জমির মাটি।*
*কৃষি জমি রক্ষায় কোন বিশেষ আইন নেই। ফলে আমরা চাইলেও সরাসরি গিয়ে বাধা দিতে পারি না – উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পাভেল খান পাপ্পু।*
*জনগণ সচেতন না হলে শুধুমাত্র অভিযান পরিচালনা করে মাটিকাটা বন্ধ করা সম্ভব না – উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ আবদুর রহমান।*
মুরাদনগর (কুমিল্লা) প্রতিনিধি:
কুমিল্লার মুরাদনগরে গত দুই বছরে প্রশাসনের কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই উপজেলার ৫০টি ইটভাটায় ইট তৈরির চাহিদা মেটাতে কাটা হয়েছে প্রায় ১ হাজার একর কৃষি জমির মাটি। দিনে অথবা রাতে যখনই সুযোগ পাচ্ছে, তখনই ভেকু মেশিন (এস্কেভেটর) দিয়ে অবৈধ ট্রাক্টরের মাধ্যমে তিন ফসলি কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যায় ইটভাটা গুলোতে। এসব অবৈধ মাটি খেকোদের বিরুদ্ধে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলেও, কিছুতেই মাটি কাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না।
আধুনিকতার কোন ছোয়া না লাগায় উপজেলার সকল ইটভাটায় ইট তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে মাটি। তবে উন্নত ইট তৈরির ক্ষেত্রে কৃষি জমির মাটির বিকল্প নেই। ফলে প্রতি বছর গড়ে এক একটি ইটভাটায় ৮০ লক্ষ ইট তৈরিতে ব্যবহার করতে হয় প্রায় ১০ একর কৃষি জমির মাটি। সে হিসেবে গত দুই বছরে ৫০টি ইটভাটায় ৮০ কোটি ইট তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে প্রায় এক হাজার একর কৃষি জমির মাটি।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ২ বছর আগে উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে নদী-নালা খাল-বিল বাদে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য ফসলী জমি ছিলো। শ্রেণী ভেদে প্রায় সকল জমি গুলোতেই সারা বছর কোনো না কোনো ধরণের ফসল চাষ হয়। বিগত দুই বছরে অধিক মাত্রায় কৃষি জমি থেকে ইটভাটায় মাটি সংগ্রহ, অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে মাটি উত্তোলন ও বাড়ি নির্মাণ সহ বিভিন্ন কারণে প্রায় ১ হাজার হেক্টর কৃষি জমি এখন চাষের অযোগ্য হয়ে ডোবায় পরিণত হয়েছে। যা কৃষি অফিসের চলতি বছরের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাইরা গ্রামের কৃষক সহিদ মিয়া বলেন, সরকারি লোকরা চাইলে শুধু জমি থাইকা মাটি কাটানা সব অবৈধ কাজ ই বন্ধ করা সম্ভব। প্রথম প্রথম সব সরকারি স্যারেরাই কিছুদিন ভালো অভিযান চালায়। পরে আবার কয়েকদিন যাইতে না যাইতে দেহি সব আগের মতোই। একসময় মনে হয় সবই টাকার খেলা।
দারোরা গ্রামের কৃষক দিলু মিয়া বলেন, জমির মাটি বিক্রি করতে না চাইলে, একপর্যায়ে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় অনুমতি ছাড়াই মাটি কাটা শুরু করে। অধিকাংশ মাটি ব্যবসায়ীরাই ক্ষমতাশীল লোকজন। তাই ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কথাও বলা যায় না। মাটি কাটায় বাধা দিতে গেলে অনেক সময় মাইর ধরের শিকার হইতে হয়। বর্তমানে জমির মাটি কাটার ফলে বিলের প্রায় সবগুলো জমি এখন ডোবায় পরিনত হইছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশকিছু মাটি কাটা সিন্ডিকেটের সদস্যরা বলছেন, আমরা কৃষকদেরকে ন্যায্য মূল্য দিয়েই তাদের জমির মাটি ক্রয় করে থাকি। কাউকে জোর জবরদস্তি ছাড়াই সব সেক্টর ম্যানেজ করে আমরা মাটি ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ করে থাকি। অনেক অফিসার প্রথম প্রথম একটু ঝামেলা করে। পরে আবার সব ঠিক হয়ে যায়।
মুরাদনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পাভেল খান পাপ্পু বলেন, কৃষি জমি রক্ষায় কোন বিশেষ আইন নেই। ফলে আমরা চাইলেও সরাসরি গিয়ে বাধা দিতে পারি না। আমরা সকল বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানানোর চেষ্টা করি। আর উপজেলার অধিকাংশ কৃষকরাই জমি বর্গা-পত্তন নিয়ে চাষ করে। ফলে প্রকৃত মালিক কৃষক না হওয়ায় জমির মর্যাদা বোঝে না। নগদ টাকার লোভে তারা জমির মাটি বিক্রি করে দেয়। তাদের ধারণা জমির মাটি বিক্রি করলে তারা দুইভাবে লাভবান হচ্ছে। প্রথমত জমি বিক্রির সমমান টাকা চলে আসে মাটি বিক্রির ফলে এবং দ্বিতীয়তঃ ওই জায়গাটা তার নিজের রয়ে গেল। জমির মালিকদের এই ধারণার ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে মাটি বিক্রি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মাটি কাটার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অন্যথায় এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ বছর পর এ উপজেলায় চাষযোগ্য কৃষি জমির সংকটে পড়তে হবে কৃষকদের।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ আবদুর রহমান বলেন, কৃষি জমি থেকে মাটি কাটা এটি একটি বড় অপরাধ। কারণ জমি থেকে মাটি কাটার ফলে সেই জমিটির শ্রেণী পরিবর্তন হয়ে যায়। আর প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কোন জমির শ্রেণী পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। কৃষি জমি রক্ষায় ইতিমধ্যেই এই উপজেলায় প্রচুর অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। যেখান থেকেই অভিযোগ পাচ্ছি সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক সময় কাজের ব্যস্ততার কারণে আমরা চাইলেই প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করতে পারিনা। সেক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতা খুব জরুরী। জনগণ সচেতন না হলে শুধুমাত্র অভিযান পরিচালনা করে মাটিকাটা বন্ধ করা সম্ভব না। শুধুমাত্র প্রশাসনের উপর নির্ভর করে না থেকে, সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কৃষি জমি রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।